ভূমি জরিপ
ভূমি জরিপ হচ্ছে এমন এক কৌশল, পেশা, বিজ্ঞান যা নির্দিষ্টভাবে স্থানসমূহের ভূগোলক বা ত্রিমাত্রিক অবস্থানের পারস্পারিক দূরত্ব এবং কোণ নির্ণয় করতে পারে। সাধারণত মৌজা ভিত্তিক ভূমির নকশা ও ভূমির মালিকানা সম্পর্কিত খতিয়ান বা ভূমি রেকর্ড প্রস্তুত কার্যক্রমকে ভূমি জরিপ বলা হয়।
ভূমি জরিপের ইতিহাস
প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতায় নীল নদের অতি প্লাবনের কারণে জমির সীমানা মুছে যাবার পর দড়ি দিয়ে সীমানা নির্ধারণের নথি পাওয়া গেছে। পাঠান সম্রাট শেরশাহ সর্ব প্রথম এ উপমহাদেশে জরিপ প্রথা চালু করেন। পরবর্তীতে মোঘল সম্রাট আকবরের একজন অন্যতম সভাসদ টোডরমল সার্ভে ও সেটেলমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনা করেন। কিন্তু উক্ত কার্যক্রম সম্পূর্ণ এবং plot-to-plot সার্ভে কার্যক্রম ছিলনা বরং একটি সংক্ষিপ্ত কার্যক্রম ছিল।
রনাল জরিপ
১৭৭৪ সালে প্রখ্যাত ভূগোলবিদ জেমস রনাল উপমহাদেশের সার্ভেয়ার জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পেয়ে ১৭৮০ সালে Plan of the environs of the city of Dhaka প্রণয়ন করেন। অতঃপর বাংলা ও বিহারের ৮টি বিভাগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের Index Map তৈরি করেন।
ত্রিগনোমেট্রিক্যাল জরিপ
১৮০২ সনে মিঃ উইলিয়াম ল্যাম্বটন এর নেতৃত্বে সমগ্র ভারতে ত্রিগনোমেট্রিক্যাল জরিপ শুরু হয়। ভবিষ্যতে সমগ্র ভারতে যাতে সঠিক ও নির্ভুল নক্সা প্রস্তুত করা যায় সে লক্ষ্যে বিভিন্ন এলাকায় জি,টি পিলার স্থাপনই এ জরিপের উদ্দেশ্য ছিল। সরেজমিনে সঠিক ত্রিভুজ অংকন করে ত্রিভুজের বাহু ব্যবহার দ্বারা একাধিক ত্রিভুজ অংকন ও প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে এই পিলার স্থাপিত হয়েছিল।
থাকবাস্ত জরিপ :
জমিদারী সীমানা সংক্রান্ত বিরোধ মীমাংসার জন্য জমিদাররা ১৮৪৬ সাল পর্যন্ত থাকবাস্ত জরিপ কার্য পরিচালনার মাধ্যমে জমিদারী এলাকার সীমা নির্ধারণ করা হয়। এ জরিপে ভূ-সম্পত্তি ও গ্রামগুলোর সীমানা পৃথককরণের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়।
রাজস্ব জরিপ :
থাকবাস্ত জরিপে প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে জমিদারী এলাকার আয় নির্ণয়ের জন্য ১৮৪৭ সাল থেকে ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত রাজস্ব জরিপ পরিচালনা করা হয়। এ জরিপ দক্ষ আমিনগণ দ্বারা পরিচালিত হয় বিধায় প্রথম বৈজ্ঞানিক জরিপ বলা হয়।। এ জরিপের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ জমিদারী এলাকার বাইরের ভূমিকে খাস ভূমি হিসেবে চিহ্নিত করে কালেক্টরের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। এ জরিপে প্রশাসনের প্রয়োজনীয় তথ্য প্রস্তুত করা হয়। কর্ণেল মিঃ স্মিত এর অধীনে এ জরিপ পরিচালিত হয়।
খসড়া জরিপ :
থাকবাস্ত জরিপ ও রাজস্ব জরিপ পরিচালনাকালে যেসব ভূমি অস্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত প্রদান করা হত ও যেসব এলাকায় স্থায়ীভাবে বন্দোবস্তকৃত ভূমিতে স্বত্ব নিয়ে বিরোধ বিদ্যমান ছিল এবং থাকবাস্ত জরিপের নক্সা যেখানে ছিলনা সেসব এলাকায় খসড়া জরিপ পরিচালিত হত। এতে ১৬ ইঞ্চি সমান ১ মাইল স্কেলে জরিপ কর্মীগণ ফিল্ডবুকে বিভিন্ন তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করতেন। যেমন তৌজি নম্বর, মালিকের নাম, দখলকারী রায়তের নাম, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ক্ষেত্রফল, মাটির বর্ণনা, উৎপাদিত ফসলের বর্ণনা ইত্যাদি।
দিয়ারা জরিপ
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এ দেশে প্রতিনিয়ত নদী ভাঙ্গনের ফলে বিস্তীর্ণ এলাকা নদী বা সাগর গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। আবার কোথাও কোথাও নতুন চর জেগে ওঠে। এসব নদী ভাঙ্গন এলাকা জরিপ করার জন্য ১৯৬৩ সালে একটি স্থায়ী দিয়ারা সেটেলমেন্ট অফিস স্থাপন করা হয়। দরিয়া শব্দটি হতে দিয়ারা শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে।
সি.এস. জরিপ
দেশের সাধারণ জনগণকে প্রজাসত্ত্বের স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে ১৮৮৫ সালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন পাশ করা হয়। ১৮৮৮ সনে ভূমি রেকর্ড দপ্তর সৃষ্টি করা হয় এবং সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সহায়তায় কক্সবাজার জেলার রামু থানায় কিস্তোয়ার জরিপ ও খতিয়ান প্রণয়নের কাজ আরম্ভ হয়। ১৮৯০ সালে অত্যন্ত সফলভাবে সমাপ্ত হলে চট্টগ্রাম জেলায় ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে শুরু হয় এবং ১৮৯৮ সালে সফলতার সঙ্গে সমাপ্ত হয়। এর পর সমগ্র পূর্ববাংলায় সিএস জরিপ পরিচালিত হয় এবং ১৯৪০ সনে দিনাজপুর জেলায় জরিপের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। উল্লেখ্য যে বৃহত্তর সিলেট জেলা তখন আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত থাকায় সিএস জরিপ পরিচালিত হয়নি।
এস. এ. পূর্ববর্তী সংশোধনী জরিপঃ
দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে সিএস জরিপ চলায় যে সকল এলাকায় প্রথম জরিপ হয়েছে; সে সকল ভূমির প্রকৃতি ও মালিকানার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ফলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম, ফরিদপুর ও বাকেরগঞ্জ জেলায় নতুন করে সংশোধনী জরিপ শুরু হয়। ১৯৫২ সালে সর্বশেষ বাকেরগঞ্জ জেলার সংশোধনী জরিপ শেষ করে খতিয়ান চুড়ান্ত প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে জমিদারী হুকুম দখল ও প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হওয়ায় আর কোন জেলায় সংশোধনী জরিপ পরিচালিত হয়নি।
এস.এ. জরিপ
দেশ বিভাগের পর জমিদারী হুকুম দখল ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ সনের ১৬ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলার পার্লামেন্টে পাশ হয় এবং গভর্নর জেনারেলের সম্মতি লাভের পর ১৯৫১ সনের ১৬ মে তারিখ ঢাকা গেজেটে প্রকাশিত হয়। এ আইনের মাধ্যমে জমিদারদের অধিভুক্ত সম্পত্তির মূল্য নির্ধারণ করে ক্ষতিপূরণ প্রদানের মাধ্যমে জমিদারী এস্টটগুলো অধিগ্রহণ করা হয় এবং প্রজার নামে খতিয়ান প্রণয়ন করে মালিকানা প্রদান করা হয়। এস,এ জরিপ ১৯৫৬ সনের ১৪ এপ্রিল শুরু হয় এবং ১৯৬৩ সনে শেষ হয়। এস এ জরিপের খতিয়ান ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রণীত হয়নি এবং ইহা কোন মাঠ পর্যায়ের সরেজমিন জরিপ ছিল না। জেলা প্রশাসনের কর্মচারীগণ জমিদারদের কাচারিতে বসে পত্তন রেজিস্টার দেখে এস, এ খতিয়ান প্রণয়ন করেন।
আরএস জরিপ
এস,এ জরিপ মাঠ পর্যায়ের সরেজমিন জরিপ ছিল না। এ জরিপের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল জমিদারী এস্টেটগুলোকে অধিগ্রহণ করা এবং দখলদার ভূমি মালিকদের সরাসরি সরকারের অধীনে নিয়ে আসা। জমিদারদের কাছারিতে বসে পত্তন রেজিস্টার দেখে জেলা প্রশাসনের কর্মচারীগণ প্রজার নামে খতিয়ান খোলে। কাজেই এর বিশুদ্ধতা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তাই এস এ জরিপের পরপরই আর একটি সংশোধনী জরিপ শুরু করা হয়। ১৯৬৫-৬৬ সালে রাজশাহী জেলায় সংশোধনী জরিপ শুরু হয়। দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, সিলেট, খুলনা ও বরিশাল জোনে এ জরিপ এখনও চলমান।
মহানগর জরিপ
সিএস, এসএ এবং আরএস এই তিন প্রকার জরিপ ছাড়াও ঢাকা মহানগরী এলাকাভুক্ত মৌজাসমূহে অতি সম্প্রতি একটি বিশেষ জরিপের মাধ্যমে মৌজা নক্সা ও স্বত্বলিপি প্রস্তুত হয়েছে। ইহা মহানগরী জরিপ নামে পরিচিত্ এই জরিপটিও একটি সংশোধনী জরিপ। তবে অধিক্ষেত্রভুক্ত সকল মৌজায় ক্যাডাষ্ট্রাল জরিপের মাধ্যমে বিভিন্ন স্কেলে নতুন মৌজা ম্যাপ প্রস্তুত করা হয়েছে বিধায় একে ক্যাডাস্ট্রাল জরিপও বলা যায়। মহানগরী জরিপ শুধু ঢাকা মহানগর এলাকায় পরিচালিত হয়েছে।
বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভে
ডিজিটাল যন্ত্রপাতি ও সফটওয়্যার ব্যবহার করে নির্ধারিত জিওডেটিক কন্ট্রোল নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ETS এর সহায়তায় প্রতিটি দাগের প্রতিটি বাঁকের স্থানাংক নির্ণয়ের মাধ্যমে মৌজাভিত্তিক ভূমির নক্সা ও প্লট ভিত্তিক মালিকানা রেকর্ড প্রণয়নে যে ভূমি জরিপ সম্পাদন করা হয় তাহা ডিজিটাল জরিপ নামে পরিচিত। সরকারের ডিজিটালাইজেশনের অংশ হিসাবে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর কর্তৃক ২০১৩ হতে GNSS/ ETS/ Drone মেশিনের সাহায্যে ডিজিটাল পদ্ধতিতে জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।