নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভূমি জরিপ কার্যক্রম সম্পন্নকরণে অনলাইন ভূমি জরিপ সফটওয়ারের ভূমিকা
মো: মোমিনুর রশীদ
পরিচালক (ভূমি রেকর্ড)
ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর
১। ভূমিকা:
ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত ভূমি জরিপে কম্পিউটার সফটওয়ারের প্রয়োগ করার তথা ভূমি জরিপ পদ্ধতি অটোমেশন করার লক্ষ্যে ভূমি জরিপের সকল স্তরের (ম্যাপ প্রণয়ন, খানাপুরি স্তর, বুঝারত স্তর, তসদিক স্তর, খসড়া প্রকাশনা স্তর, আপত্তি স্তর, আপীল স্তর, যাঁচ স্তর, ফেয়ার কপিকরণ স্তর, মুদ্রণ স্তর, চূড়ান্ত প্রকাশনা স্তর, হস্তান্তর স্তর) কাজ ডিজিটাল প্রযুক্তি নির্ভর কম্পিউটার সফটওয়ার ভিত্তিক ডাটাবেজের মাধ্যমে পরিচালনা করার নিমিত্ত অনলাইন ভূমি জরিপ সফটওয়ারটি প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অতি অল্প সময়ে ভূমি জরিপের সকল স্তরের কাজ সম্পন্নক্রমে ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগের কাছে মৌজার রেকর্ড হস্তান্তর করা সম্ভব হচ্ছে। একই সাথে অনলাইনে জরিপ রেকর্ড (ম্যাপ ও খতিয়ান) জনগণের জন্য উন্মুক্ত থাকায় জনগণের দোরগোড়ায় ভূমি জরিপ সেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছে এবং জনঘণের ভোগান্তি ও হয়রাণি অনেকাংশে লাঘব হচ্ছে।
২। অনলাইন ভূমি জরিপ সফটওয়ার নির্মাণের উদ্দেশ্যসমূহ:
(১) ভূমি মালিকদের মাঠ স্তর হতেই প্রস্তুতকৃত ডিজিটাল ম্যাপ জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা এবং নির্ভুল ভূমি মালিকানা খতিয়ান সরবরাহ করা;
(২) ভূমি জরিপের স্তরে স্তরে ভূমি মালিকানা খতিয়ান ও ম্যাপের টেম্পারিং চিরতরে দূরীকরণ;
(৩) জরিপ রেকর্ড প্রস্তুতে সংঘটিত ভুলত্রুটি অটোমেটিক সনাক্তকরণ এবং মিসটেক পাশের মাধ্যমে অফিসার কর্তৃক সর্বনিম্ন সময়ে যাঁচ সম্পন্নকরণ;
(৪) খতিয়ান প্রস্তুতের সাথে সাথে বাই প্রোডাক্ট হিসেবে হাল-সাবেক, খতিয়ানের সূচী, দাগের সূচী, যাঁচ রিপোর্ট ইত্যাদি সৃজন।
(৫) খসড়া প্রকাশনা (মালিকের নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী সাজানো) কাজটি এক ক্লিকে সম্পন্নকরণ এবং এর ফলে প্রায় ৬ মাস থেকে বারো মাসের সময় সাশ্রয় হয়।
(৬) খসড়া প্রকাশনা চলাকালীন সময়ে অনলাইনে জনগণ হতে আপত্তি গ্রহণ ফলে জনগণের আপত্তি দাখিলের ক্ষেত্রে জনগণের ভোগান্তি ও অর্থ ব্যয় কমানো।
(৭) আপত্তি ও আপীল মামলার রায় অনলাইনে প্রকাশ ও অনলাইনে রায়ের জাবেদা নকল প্রদান।
(৮) খসড়া প্রকাশনা স্তর, আপত্তি স্তর, আপীল স্তর, যাঁচ স্তর, ফেয়ার কপিকরণ স্তর, মুদ্রণ স্তর, হস্তান্তর স্তরের জন্য অযথা ৩-৩৫ বছরের সময়ক্ষেপণ কমানো;
(৯) ব্যাপক জনবল সাশ্রয় সম্ভব। এ সফটওয়ার ব্যবহারে ৩য় শ্রেণির কোন কর্মচারীর প্রয়োজন হয়না; শুধুমাত্র রেকর্ড সংরক্ষণ ব্যতীত;
(১০) ডাইনামিক ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে সকল খতিয়ান ও ম্যাপ জনগণের জন্য উন্মুক্তকরণ;
(১১) জাতীয় পরিচয়পত্র ডাটাবেজের সাথে ভূমি মালিকদের তথ্যাদি ইন্টিগ্রেশন সম্পন্নকরণ;
(১২) সেটেলমেন্ট বিভাগ হতে ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগের নিকট রেকর্ড ভলিউম হার্ডকপিতে হস্তান্তরের পাশাপাশি ইন্টিগ্রেটেড প্লাটফরমের মাধ্যমে সফটকপি হস্তান্তরকরণ।
৩। বাস্তবায়নের সময়কাল:
২০১৯ সালে সফটওয়ারটি প্রস্তুতক্রমে এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক ল্যাপটপ, ডেস্কটপ কম্পিউটার, প্রিন্টার, প্লটার, সার্ভার ক্রয়ক্রমে এবং ঢাকা জোনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ট্রেনিং প্রদানের মাধ্যমে ঢাকা জোনে চলমান ভূমি জরিপে অনলাইন ভূমি জরিপ সফটওয়ারটি ব্যবহার শুরু করা হয়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী, সচিব, মহাপরিচালক (ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর) মহোদয়গণ কর্তৃক সফটওয়ারটির কার্যক্রম বিষয়ে উপস্থাপনা দেখেছেন এবং সফটওয়ারটি ব্যবহারের প্রশাসনিক অনুমোদন প্রদান করেন। বর্তমানে দেশের সবকটি জোনে সফটওয়ারটির মাধ্যমে জরিপের সকল স্তরের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।
৪। প্রেক্ষাপট ও বিস্তারিত কার্যক্রম:
ট্র্যাডিশনাল ভূমি জরিপ ব্যবস্থাপনায় আমিনগণ ভূমি মালিকদের নিকট হাতে লেখা খতিয়ান প্রদান করতেন যা অনেক ক্ষেত্রে অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য ছিল। স্তরভিত্তিক ট্র্যাডিশনাল যে পদ্ধতিতে খতিয়ানগুলি প্রস্তুত হয়ে হস্তান্তরিত হতো তা নিম্নরূপ:
(ক) ট্রাভার্স ও ম্যাপ প্রণয়ন স্তর: এ স্তরে থিওডোলাইট, খাকা, ত্রিপায়া টেবিল ও গান্টার চেইন ব্যবহারের মাধ্যমে ম্যাপ প্রস্তুত হতো যেখানে প্রতিটি ট্র্যাডিশনাল ম্যাপে অনেকগুলি মোরব্বা (চতুর্ভুজ) কাটার মাধ্যমে ছোট ছোট ভাগ করে ম্যাপ অংকিত হতো এবং যেকোনো ভুল ঐ মোরব্বা (চতুর্ভুজ) এর মধ্যেই বিভাজন করে দেওয়া হতো ফলে ট্র্যাডিশনাল ম্যাপে কিছুটা ভুল রয়েই গিয়েছে। যথাযথভাবে ম্যানুয়ালি মৌজা মিলকরণ সম্ভব না হওয়ায় ২টি মৌজার মাঝে গ্যাপ ও ওভারল্যাপের ও সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে জিএনএসএস, ইলেকট্রনিক টোটাল স্টেশন ও সার্ভে গ্রেড ড্রোনের সহায়তায় ডিজিটাল ম্যাপ প্রণয়ন করা হচ্ছে ফলে ম্যাপগুলি নিখুঁত হচ্ছে এমনকি ২টি মৌজার মাঝে গ্যাপ ও ওভারল্যাপের সৃষ্টি হচ্ছে না।
(খ) খানাপুরী-বুঝারত স্তর: এ স্তরে আমিনগণ ভূমি মালিকদের নিকট হাতে লিখা খতিয়ান প্রদান করতেন যা অনেক ক্ষেত্রে অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য ছিল। এমনকি মালিকদের নামের বানান ভুল, খতিয়ানের ২ নং কলামে মালিকদের অংশের যোগফল ষোলআনা না হওয়া, একই প্লটের মোট জমির পরিমাণ ও জমির শ্রেণি ঐ প্লটের শেয়ারড ভিন্ন ভিন্ন খতিয়ানে লেখার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণি ও পরিমাণ লেখা জনিত ত্রুটি, মালিকদের প্রাপ্য অংশ অনুযায়ী যোগফল ষোল আনা না হওয়া, এমনকি একই প্লটের মোট জমির পরিমাণ শেয়ারড ভিন্ন ভিন্ন খতিয়ানে লেখার ক্ষেত্রে যোগফল মোট জমির পরিমাণের চেয়ে কম বা বেশী হয়ে যাওয়া যা গাণিতিক ভুল, ক্লারিকাল ভুল ইত্যাদি হিসেবে পরিচিত, এছাড়া একই জমি প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও দোকর (ডাবল) রেকর্ড সৃষ্টি করা হতো। উল্লিখিত ভুলগুলি মনোযোগ দিয়ে কাজ না করাই এমনকি হিউম্যানলি ইম্পসিবল হওয়ার কারণে জরিপের কোন স্তরেই ধরা পড়ত না। এমনকি ভূমি জরিপের স্তরে স্তরে টেম্পারিং ছিল অন্যতম অনিয়ম। ফলে ভুল খতিয়ান হস্তান্তর হয়ে যাওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে ভূমি মালিকদের বিড়ম্বনার শেষ থাকত না এবং বিভিন্ন বিভাগের দ্বারা পদে পদে হয়রানির স্বীকার হতে হতো। অনেক ক্ষেত্রে সামান্য মুদ্রণ ত্রুটির কারণে ভূমি মালিকদেরকে সিভিল কোর্ট/ ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে হয় এবং বছরের পর বছর মামলা শুনানিতে সময় ক্ষেপণ, অর্থ খরচ, হয়রানির স্বীকার হতে হয়। সিভিল কোর্ট/ ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এ সমস্যা নিরসন করার উদ্দেশ্যেই অনলাইন ভূমি জরিপ সফটওয়ার প্রস্তুতির মাধ্যমে সঠিকভাবে ভূমি জরিপ সম্পন্নকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ স্তরে ভূমি মালিকদের মাঠ স্তর হতেই নির্ভুল ভূমি মালিকানা খতিয়ান সরবরাহ করা যাচ্ছে। এছাড়া খতিয়ানে কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সফটওয়ারটি অটোমেটিক্যালি গাণিতিক ভুল, ক্লারিকাল ভুল, দোকর রেকর্ড সৃষ্টির বিষয়টি ধরিয়ে দেয় যা তাৎক্ষণিক সমাধান করা সম্ভব হয় এবং উল্লেখ্য যে ট্র্যাডিশনাল ভূমি জরিপ ব্যবস্থাপনায় চিরাচরিতভাবে টেম্পারিং করার যে সুযোগ ও সম্ভাবনা ছিল তা চিরতরে দূরকরণ করা সম্ভব হয়েছে।
(গ) খসড়া প্রকাশনা স্তর: এ স্তরে খানাপুরী-বুঝারত স্তরে সৃজিত সকল খতিয়ান মালিকদের নামের আদ্যাক্ষর অনুসারে সাজানো হয়। ট্রাডিশনালি এ স্তরে আদর্শলিপি বই নিয়ে ফ্যান বন্ধ করে এ কাজটি করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ ছিল এবং এ স্তরে হাতে লিখে খতিয়ানের সূচী, দাগের সূচী, হাল-সাবেক প্রণয়ন করতে প্রায় ৫/৬ মাস লেগে যেত। বর্তমানে কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সফটওয়ারটির মাধ্যমে অটোমেটিক্যালি খতিয়ানের সূচী, দাগের সূচী, হাল-সাবেক তৈরি হয় এবং এক ক্লিকে খতিয়ান মালিকদের নামের আদ্যাক্ষর অনুসারে সাজানো সম্ভব হয়। ফলে এ স্তরে কাজের সাথে জড়িত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কষ্ট কমে গিয়েছে এবং ব্যাপক সময় সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে।
(ঘ) আপত্তি স্তর: এ স্তরে খসড়া প্রকাশনা দেয়া খতিয়ানের উপর ভূমি মালিকদের দাখিলকৃত আপত্তি মামলাগুলি শুনানি করা হয় এবং সে সময় মৌজার মূল ওয়ার্কিং ভলিউম আপত্তি শুনানীর অফিসারকে সরবরাহ করা হয়। ভলিউম হাতে থাকার ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত টেম্পারিং হয়ে থাকে যা বর্তমানে অনলাইন ভূমি জরিপ সফটওয়ার এর মাধ্যমে কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহারের দ্বারা আপত্তি শুনানির অফিসারকে যে যে খতিয়ানে আপত্তি মামলা জড়িত ঠিক সেই সেই খতিয়ানগুলিকে সংশোধনের অনুমতি প্রদান করা হয়। ফলে আপত্তি না পড়া খতিয়ানগুলিতে কোন প্রকার টেম্পারিং করার সুযোগ থাকে না। কাজেই ট্র্যাডিশনাল ভূমি জরিপ ব্যবস্থাপনায় চিরাচরিতভাবে টেম্পারিং করার যে সুযোগ ও সম্ভাবনা ছিল তা চিরতরে দূরকরণ করা সম্ভব হয়েছে।
(ঙ) আপীল স্তর: এ স্তরে আপত্তি মামলায় প্রদত্ত রায়ের অসম্মতিতে আপত্তি মামলার পক্ষগণের পক্ষ হতে আপীল দায়ের হয় এবং মামলাগুলি যথাবিধি শুনানি করা হয়। কিন্ত সে সময় আপীল শুনানীর অফিসারকে মৌজার মূল ওয়ার্কিং ভলিউমও সরবরাহ করা হয় বিধায় অনাকাঙ্ক্ষিত টেম্পারিং হয়ে থাকে যা বর্তমানে অনলাইন ভূমি জরিপ সফটওয়ার এর মাধ্যমে কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহারের দ্বারা আপীল শুনানির অফিসারকে যে যে খতিয়ানে আপীল মামলা জড়িত ঠিক সেই সেই খতিয়ানগুলিকে সংশোধনের অনুমতি প্রদান করা হয় ফলে আপীল না পড়া খতিয়ানগুলিতে কোন প্রকার টেম্পারিং করার সুযোগ থাকে না। কাজেই ট্র্যাডিশনাল ভূমি জরিপ ব্যবস্থাপনায় চিরাচরিতভাবে টেম্পারিং করার যে সুযোগ ও সম্ভাবনা ছিল তা চিরতরে দূরকরণ করা সম্ভব হয়েছে।
(চ) চূড়ান্ত প্রকাশনা স্তর: এ স্তরে প্রয়োজনীয় যাঁচ শেষে ওয়ার্কিং ভলিউম দেখে ফেয়ার কপি করা হত যা সেটেলমেন্ট প্রেসের মাধ্যমে নিজস্ব সফটওয়ারে ডাটা এন্ট্রি করার মাধ্যমে প্রিন্ট নেয়া হয় এবং ভূমি মালিকদের মাঝে বিতরণ করা হয়। এ স্তরে যথাযথ যাঁচ না হওয়ায় তথা মালিকদের নামের বানান ভুল, খতিয়ানের ২ নং কলামে মালিকদের অংশের যোগফল ষোলআনা না হওয়া, একই প্লটের মোট জমির পরিমাণ ও জমির শ্রেণি ঐ প্লটের শেয়ারড ভিন্ন ভিন্ন খতিয়ানে লিখার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণি ও পরিমাণ লিখা জনিত ত্রুটি, মালিকদের প্রাপ্য অংশ অনুযায়ী যোগফল ষোল আনা না হওয়া, এমনকি একই প্লটের মোট জমির পরিমাণ শেয়ারড ভিন্ন ভিন্ন খতিয়ানে লিখার ক্ষেত্রে যোগফল মোট জমির পরিমাণের চেয়ে কম বা বেশী হয়ে যাওয়া যা গাণিতিক ভুল, ক্লারিকাল ভুল হিসেবে পরিচিত, ওছাড়া একই জমি প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও দোকর রেকর্ড প্রস্তুত হতো। উল্লিখিত ভুলগুলি মনোযোগ দিয়ে কাজ না করাই এমনকি হিউম্যানলি ইম্পসিবল হওয়ার কারণে জরিপের কোন স্তরেই ধরা পড়ত না। এমনকি যিনি ১টি মৌজা ৬ মাসে যাঁচ করতে পারতেন তাকে ৪/৫টি মৌজা যাঁচ করতে বলা হত ফলে মৌজার যাঁচ হতনা এবং এ স্তরেই মৌজা ১৫ বছর থেকে ২০ বছর পড়ে থাকত। এমনকি খতিয়ানের টেম্পারিং বিষয়টি ছিল অন্যতম ওপেন সিক্রেট অনিয়ম। ফলে ভুল খতিয়ান হস্তান্তর হয়ে যাওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে ভূমি মালিকদের বিড়ম্বনার শেষ থাকত না এবং বিভিন্ন বিভাগের দ্বারা পদে পদে হয়রানির স্বীকার হতে হতো। অনেকক্ষেত্রে সামান্য মুদ্রণ ত্রুটির কারণে ভূমি মালিকদেরকে সিভিল কোর্ট/ ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে হয় এবং বছরের পর বছর মামলা শুনানিতে সময় ক্ষেপণ, অর্থ খরচ, হয়রানির স্বীকার হতে হয়। সিভিল কোর্ট/ ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এ সমস্যা নিরসন করার উদ্দেশ্যেই অনলাইন ভূমি জরিপ সফটওয়ার প্রস্তুতির মাধ্যমে সঠিকভাবে ভূমি জরিপ সম্পন্নকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ স্তরে ভূমি মালিকদের যাঁচ জনিত নির্ভুল ভূমি মালিকানা খতিয়ান সরবরাহ করা যাচ্ছে। এছাড়া খতিয়ানে কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সফটওয়ারটি অটোমেটিক্যালি গাণিতিক ভুল, ক্লারিকাল ভুল, দোকর রেকর্ড সৃষ্টির বিষয়টি ধরিয়ে দেয় যা তাৎক্ষণিক সমাধান করা সম্ভব হয় এবং উল্লেখ্য যে ট্র্যাডিশনাল ভূমি জরিপ ব্যবস্থাপনায় চিরাচরিতভাবে টেম্পারিং করার যে সুযোগ ও সম্ভাবনা ছিল তা চিরতরে দূরকরণ করা সম্ভব হয়েছে।
৫। সফটওয়ারটি ব্যবহারের ফলে যে ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে:
যেহেতু মৌজার আপীল স্তর শেষ হওয়ার ৫০/৭০ দিনের মধ্যেই মৌজার রেকর্ড চূড়ান্ত প্রকাশনা করা সম্ভব হচ্ছে সেহেতু জরিপে অযথা সময় ক্ষেপণ হচ্ছে না যার ফলে প্রায় ৩-৩০ বছরের সময় বেঁচে যাচ্ছে। প্রতিটি ব্যক্তি/ ভূমি মালিক মাঠস্তর হতেই হাতে লেখা খতিয়ানের পরিবর্তে প্রিন্টেড (মুদ্রিত) খতিয়ান পাচ্ছেন এবং ঘরে বসেই তার ভূমি মালিকানার খতিয়ানটি অনলাইনের মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছেন এবং নিশ্চিত হচ্ছেন যে তার মালিকানা খতিয়ানটি টেম্পারিং হয়নি এমনকি আপত্তি মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে রেকর্ড খুজতে গিয়ে যে বিড়ম্বনা হতো এবং কোন কোন খতিয়ানের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে হবে তা খুজতে গিয়ে পূর্বে যে বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতেন তা লাঘব করা গেছে। বর্তমানে এ সফটওয়ারটি ব্যবহারের মাধ্যমে দিনাজপুর জোনের প্রায় ৭০০টি মৌজার রেকর্ড ৩ বছরের মধ্যে হস্তান্তর করা সম্ভব হয়েছে। সফটওয়ারটি ব্যবহার না করা হলে আগামী ১০ বছরেও তা সম্ভব হতো না। এ সফটওয়ারটি ব্যবহারের ফলে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সকল জোনের এপিএ তে ১৭০টি মৌজা রেকর্ড হস্তান্তরের টার্গেটের বিপরীতে প্রায় ৮০০টি মৌজা রেকর্ড হস্তান্তর করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া নতুন জরিপের ক্ষেত্রে ট্রাডিশনালি যেখানে মৌজা হস্তান্তর করতে ২০/২৫ বছর লাগত; সেখানে এ সফটওয়ারটি ব্যবহারের মাধ্যমে ২/৩ বছরের মধ্যেই হস্তান্তর করা সম্ভব হচ্ছে। অন্যান্য সকল জোনে এ সফটওয়ারটি ব্যবহারের মাধ্যমে আশা করা যাচ্ছে যে আগামী ১/২ বছরের মধ্যেই ট্র্যাডিশনাল জরিপের পেন্ডিং প্রায় ৩০০০ মৌজার রেকর্ড হস্তান্তর করা সম্ভব হবে।
৬। অংশীজন ও উদ্যোগের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা:
জনগণের মধ্যে মাঠ স্তর হতে প্রিন্টেড খতিয়ান প্রদানের ফলে জনগণের মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। এছাড়া ভূমি মালিকানার সকল তথ্য ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত থাকার ফলে ভূমি মালিকগণ ঘরে বসেই যাঁচাই করে নিতে পারছেন। তথ্যের জন্য অযথা অফিস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্বারে-দ্বারে ঘুরা ও হয়রাণি হতে হচ্ছেনা। ফলে জনগণের ব্যাপক সম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অন্যদিকে সফটওয়ারটির মাধ্যমে খতিয়ান সৃজনকালে বায়প্রোডাক্ত হিসেবে অটোমেটিক্যালি দাগের সূচি, খতিয়ানের সূচি, হাল-সাবেক, ছুট খতিয়ান, বাটা খতিয়ানের তালিকা, ছুট দাগ, বাটা দাগের তালিকা তৈরী হচ্ছে। এছাড়া অটোমেটিক্যালি যাঁচ প্রতিবেদন প্রস্তুত হচ্ছে বিধায় বিভিন্ন স্তরে নিয়োজীত কর্মকর্তা-কর্মচারীগণের উল্লিখিত রিপোর্টগুলি হাতে লিখে প্রস্তুত করা লাগছে না। যা প্রচুর সময় সাপেক্ষ ও প্রচুর পরিশ্রমের কাজ ছিল যা হতে কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ রেহাই পাচ্ছেন। যাঁচ কাজে এবং ফেয়ার কপিকরণ কাজে অযথা প্রচুর সময় ব্যয় করা লাগছেনা এবং সর্বোপরি টেম্পারিং মুক্ত খতিয়ান সৃজিত হচ্ছে বিধায় কর্মকর্তা-কর্মচারীগণের ব্যাপক সম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা যাচ্ছে এবং তারা ব্যাপক কষ্ট করা হতে পরিত্রাণ পাচ্ছেন। আপীল স্তর শেষ হওয়ার ৫০/৭০ দিনের মধ্যে মৌজার রেকর্ড চূড়ান্ত প্রকাশনা করা সম্ভব হচ্ছে।
৭। সফটওয়ারটি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জসমূহ ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পদক্ষেপ:
অনলাইন ভূমি জরিপ সফটওয়ারটি বিসিসির ডাটা সেন্টারে হোস্টিং করা হয়েছে। সফটওয়ারটি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জসমূহ হল সাইবার হ্যাকিং/ হামলা প্রতিরোধ, বিভিন্ন জোনে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ল্যাপটপ, ডেস্কটপ কম্পিউটার, প্রিন্টার, প্লটার, পস মেশিন ক্রয় বাবদ অর্থের সংস্থানকরণ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ট্রেনিং প্রদানের মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ, সফটওয়ারের মেইটেন্যান্স, রিসার্চ, আপগ্রেডেশন, খতিয়ান ও ডিজিটাল ম্যাপের মধ্যে আন্ত:সমন্বয়করণের পরবর্তীতে ম্যাপের পার্সেল বিভক্তিকরণ, পার্সেল একত্রিকরণ, টেকনোলজি ট্রান্সফার, নিরাপত্তা ত্রুটি পরীক্ষা ও নিরসন, সফটওয়ার কোয়ালিটি টেস্টিং, ভিএপিটি টেস্টিং, ডিজাস্টার মোকাবিলা, নিজস্ব সফটওয়ার প্রোগ্রামার, জিআইএস প্রোগ্রামার, জিআইএস বিশেষজ্ঞ ও ডাটাবেজ এ্যাডমিনিস্ট্রেটর নিয়োগের মাধ্যমে নিজ দপ্তরের সক্ষমতা উন্নয়ন প্রভৃতি। এছাড়া আর্কজিআইএস এন্টারপ্রাইজ ভার্সনের অনুরূপ নিজস্ব ম্যাপ প্রস্তত ও এডিটিং সফটওয়ার প্রস্তুত ও অনলাইন ভূমি জরিপ সফটওয়ারের সাথে ইন্টিগ্রেশন সম্পন্নকরণ। উল্লিখিত চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে যেমন: মন্ত্রণালয়ে পত্র যোগাযোগ, বিসিসিতে পত্র যোগাযোগ, জাতীয় ডাটা সেন্টারের সাথে পত্র যোগাযোগ প্রভৃতি।
৮। সফটওয়ারটি সংক্রান্ত ওয়েবসাইট: http://www.settlement.gov.bd
৯। লেখকের ভূমিকা/ সম্পৃক্ততা:
লেখকের ভূমি রেকর্ড ও জরিপ বিভাগে পদায়নের পর প্রথমে এ অধিদপ্তরের ডোমেইন সম্পর্কে নিশ্চিত হন। পরবর্তীতে সেটেলমেন্ট প্রেসে অফলাইন খতিয়ান ডাটাবেজ সফটওয়ারে থাকা সকল খতিয়ান তথ্য জনগণের জন্য উন্মুক্তকরণে অধিদপ্তরকে সহায়তা করেন। বর্তমানে www.land.gov.bd ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে সকল খতিয়ান তথ্য জনগণের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যে সবকটি জোনের ম্যাপ উন্মুক্তকরণ করা হয়েছে এবং সারাদেশের উন্মুক্ত হয়নি এমন ম্যাপগুলি উন্মুকরণ কাজ প্রক্রীয়াধীন। অপরদিকে নিম্নস্বাক্ষরকারী এ অধিদপ্তরের ডোমেইন সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত ভূমি জরিপে কম্পিউটার সফটওয়ারের প্রয়োগ করার তথা ভূমি জরিপ পদ্ধতি অটোমেশন করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। কাজটি সম্পন্ন করার জন্য সফটওয়ারের আর্কিটেকচার প্রণয়ন করেন এবং সফটওয়ার স্পেসিফিকেশন প্রস্তুতক্রমে বাজেট চাহিদা নিরূপন এবং তা পাওয়ার মাধ্যমে অনলাইন ভূমি জরিপ সফটওয়ার নির্মাণ বিষয়টি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সফটওয়ারটিতে ভূমি জরিপের সকল স্তরের (ম্যাপ প্রণয়ন, খানাপুরি স্তর, বুঝারত স্তর, তসদিক স্তর, খসড়া প্রকাশনা স্তর, অনলাইনে আপত্তি গ্রহণ, আপত্তি স্তর, অনলাইনে আপীল গ্রহণ, আপীল স্তর, যাঁচ স্তর, ফেয়ার কপিকরণ স্তর, মুদ্রণ স্তর, চূড়ান্ত প্রকাশনা স্তর, হস্তান্তর স্তর) কাজ কম্পিউটার সফটওয়ার ভিত্তিক ডাটাবেজের মাধ্যমে পরিচালনা করার নিমিত্ত অনলাইন ভূমি জরিপ সফটওয়ারটি প্রস্তুত করা হয়েছে। সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সফটওয়ারটি ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক কম্পিউটার ক্রয় সম্পন্ন করেন এবং সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ট্রেনিং প্রদান করেন। সফটওয়ারটি প্রস্তুত ও ব্যবহারের কারণে ভূমি জরিপ কাজে আধুনিকতা আনয়ন, ট্রাডিশনাল সিস্টেমের সকল সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব হয়েছে। নিম্নস্বাক্ষরকারীর দিনের পর দিন এবং রাতের পর রাত নিরলস পরিশ্রম করার মাধ্যমে এ সিস্টেমটি সফলতার মুখ দেখেছে।